#আমি_মোটরসাইকেল_নিয়ে_একাই_ভালো. বয়সের সাথে আমি যে নিজে cynical হয়ে যাচ্ছি, পরিষ্কার বুঝতে পারি। কিছু লোকজনের ব্যাপার–স্যাপার আমার নিজের পছন্দসই না হলে (তা ঠিক–ভুল যাই হোক না কেন) তাকে এড়িয়ে চলাটাকেই আজকাল শ্রেয় মনে হয়। একজন বন্ধুস্থানীয় বাইকার স্যারের সাথে মোটরসাইকেল চালানোর সুযোগ ঘটলো… বয়সে আমার থেকে বড়ই তিনি।
১) প্রথম দিন, সকাল সাড়ে পাঁচটায় পৌছোনোর কথা, তিনি পৌছোলেন সোয়া ছটায়, বললেন গতরাতে আড্ডা দিয়ে চারটেতে শুয়েছেন। বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম।
২) আমিই রাস্তায় তিনজনকে লিড করছিলাম। ট্রাকে ভরা ন্যাশনাল হাইওয়েতে আমার স্পীড ভালোই থাকে… ৯০–১০০ কিমি প্রতি ঘন্টায়, যেটা বেশ ঠিকঠাকই … তিনি প্রথম হল্টেই জানিয়ে দিলেন… ১২০র নিচে চালালে তাঁর ঘুম পায়, আমি যেন স্পীড বাড়াই। বয়সে বড়, তাও বলতেই হল… “আপনি এগিয়ে যান“, কিন্তু তিনি বললেন, “না না, কষ্ট হলেও, তোমাদের সাথেই থাকবো“।
৩) আমি ১০০ কিমি বা ১০০ মিনিটে হল্ট করি ৫ –১০ মিনিটের। এবারও ১০০ কিমিতে দাঁড়াতেই তিনি বললেন… ” ও… হাঁফিয়ে পড়েছো বুঝি? আমি তো এই ওয়ার্ম আপ হচ্ছিলাম, আরও ১০০কিমি গিয়ে দাঁড়ালে ঠিক ছিল“। বয়সে বড়, তাও বলতেই হল… “আপনি এগিয়ে যান“, কিন্তু তিনি বললেন, “না না, কষ্ট হলেও, তোমাদের সাথেই থাকবো“।
৪) ব্রেকফাস্ট খাবার হল্ট ২০–৩০ মিনিট হওয়ার কথা, আমার খাদ্য একটা স্যান্ডউইচ, এক কাপ কফি। তিনি দেড় ঘন্টা ধরে চারটে আলুর পরোটা, এক প্লেট দই, আলুর তরকারি, লস্যি খেয়ে বললেন… “আরো দুটো পরোটা বলছি, কেমন?”… বয়সে বড়, তাও বলে ফেললাম “আপনি খেয়ে টেয়ে আসুন, আমরা এগোচ্ছি, আপনি তো একশো চল্লিশে চালিয়ে আামাদের ধরেই ফেলবেন“… কিন্তু তিনি বললেন, “না না, কষ্ট হলেও, তোমাদের সাথেই থাকবো“।
৫) ছয় লেন হাইওয়ে ধরে ৩০০–৪০০ কিমি চলা আমার বোরিং লাগে; তাই ম্যাপ দেখেশুনে নদীর ধার ধরে একটা হাল্কা অফরোড ৩০ কিমির একটা রাস্তা বেছে নিয়েছিলাম, কেননা ওই রাস্তাগুলোই মজা… ১০ কিমি সেই রাস্তায় চলার পরেই তিনি তাড়াতাড়ি পাশে এসে বললেন… “রাস্তা হারিয়ে ফেলেছো তো?? এইজন্যই গুগুল–ম্যাপ শিখে নিতে হয়“। বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম।
৬) আমরা যাচ্ছিলাম এক ইতিহাসবিখ্যাত কেল্লা দেখতে, আমার ইচ্ছা ছিল পাহাড়ের ওপর কেল্লার চুড়ায় সবচেয়ে সিনারীওয়ালা ৩ তারা হোটেলে ১৮০০ টাকা করে তিনটে রুম নিয়ে থাকার, তিনি অনেক তর্ক করে তিনজনের জন্য ১২০০ করে দুটো রুম কেল্লার থেকে ৭ কিমি দূরে নিয়ে আমাদের বললেন… “দ্যাখো, তোমাদের বোকামির টাকা–খরচাটা কেমন বাঁচিয়ে দিলাম“। বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম।
৭) আমার ইচ্ছা ছিল, হোটেলে ১ টা নাগাদ পৌঁছেই কেল্লা দেখতে বেরিয়ে পড়বো, তিনি বললেন “তাড়া কি? একটু খেয়ে দেয়ে রেস্ট নেওয়া হোক“। জঘন্য ভাত ও ডাল পেঁদিয়ে তিনি তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে বললেন… ” চলো, তোমাদের কেল্লা দেখিয়ে আনি“। বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম।
৮) কেল্লায় পৌঁছে আমার প্রথম কাজ হলো একজন গাইড ভাড়া করা, কেননা গাইড ছাড়া কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন “গাইড কিসের? আমার ইতিহাসের তিনটে বই পাবলিশ হবে, আর ভারত সরকার আমাকে খনন করার জন্য ডাকছে“। আমি নিজে পদার্থবিদ্যার ছাত্র, ইতিহাসটা শখের, আর উনি বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম; কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই গাইড ভাড়া করতেই হলো। এক ঘণ্টাও দেখা হয় নি, তিনি তাড়া দিলেন… ” চলো দোকান দেখতে হবে“… বলে আমাদের একটি হ্যান্ডিক্রাফ্টের দোকানে নিয়ে গিয়ে.. দু ঘণ্টা ধরে ওনার স্ত্রীর জন্য প্রচুর শাড়ি ও জামা কিনলেন, আমি দেখলাম। উনি বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম;
৯) রাত্রে আমার সঙ্গী, ওল্ড–মন্কের বোতলটা বের করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “একটু হবে না কি?” তিনি বললেন “আমি তো শুধু মাঝে সাজে বিয়ার খাই“… বলে টলে হাফ বোতল নামিয়ে দিলেন। আমি দু পেগের লোক… আমি তো হাঁ!!! কিন্তু বয়সে বড়, তাই চুপ থাকলাম।
১০) পরদিন সকালে ফেরত আসতে বেরোনো হবে সাড়ে সাতটায় ঠিক হয়েছিলো। আমি তো অভ্যাসবশতঃ ছটায় তৈরি; তিনি সাড়ে ছটায় উঠে বললেন… “প্রথমে এক গ্লাস গরম জল, তারপর এক গ্লাস গরম জল ও লেবু, তারপর এক কাপ কফি না হলে জাগা যায় না“। সে পর্ব হবার পরে, বাথরুমে দেড় ঘন্টা কাটিয়ে, তিনি সাড়ে আটটায় তৈরি হয়ে বললেন… “একটু ডিম পাঁউরুটি খেয়েই বেরোনো হোক“। হলো খাওয়া, বেরোনো হলো নটায়।
বাড়ি পৌছুতে পৌছুতে আমি বুঝে গেছি… ভারতে তিনজনই মহাপুরুষ আছেন… রবীন্দ্রনাথ, মোদীজি আর আমাদের এই বাইকার স্যার। বাড়ি ফিরে তাই আমার প্রতিজ্ঞা… ““।